এগিয়ে আসছে ঈদ। ওই উপলক্ষে কিছুদিনের মধ্যেই দক্ষিণবঙ্গের বিপুলসংখ্যক আপনজনদের সাথে মিলিত হতে নৌপথে ঢাকা ছাড়বে। আর ওই সুযোগ কাজে লাগাতে লক্কর-ঝক্কর মার্কা ফিটনেসবিহীন লঞ্চ জোড়াতালি দিয়ে মেরামত ও রং করে পানিতে নামানো হচ্ছে। তাতে ভরা বর্ষা মৌসুমে নৌপথে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। সাধারণ যাত্রীরাও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা না করে ওসব লঞ্চে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াতে বাধ্য হন। ফলে এবার বর্ষা মৌসুমে ঈদ হওয়ায় ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে এবছরও নৌপথে ভরসা ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ। নৌপথ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে মহাসমারোহে চলছে ভাঙা আর মরিচা ধরা লঞ্চের মেরামতের কাজ। কেউ করছে লঞ্চের বডি নির্মাণের কাজ, কেউ বা পুরনো পাটাতন সরিয়ে নতুন পাঠাতনে ঝালাই করে দিচ্ছে। আবার কেউ ব্যস্ত লঞ্চের রং করার কাজে। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা চরকালীগঞ্জ ও চরমীরেরবাগ এলাকার ডকইয়ার্ডগুলোতে বিরামহীন চলছে যাত্রীবাহী ও বড় কার্গোবাহী লঞ্চগুলোর মেরামত কাজ। সকাল থেকে রাত অবধি শ্রমিকরা বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সদরঘাট এলাকার বিভিন্ন ডকইয়ার্ড ও গ্যারেজেও পুরনো নৌযান মেরামতের ধুম চলছে। ফিটনেসহীন লঞ্চগুলোকে নতুনে বদলে দিতে জোড়া দেয়া হচ্ছে লঞ্চের ভেঙে যাওয়া বিভিন্ন অংশ। মেঝে কিংবা কার্নিশে লাগানো হচ্ছে লোহার পাত। পরিবর্তন করা হচ্ছে ইন্টেরিয়র ডিজাইনে।
সূত্র জানায়, ঈদের আগে বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে ফিটনেস লাইসেন্স নিতে ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চগুলো নামমাত্র সংস্কার করা হয়। কিন্তু ওসব ডকইয়ার্ডগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈধভাবে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না। ফলে যাদের বৈধ্যতা আছে তাদেরও মাঝেমধ্যে অপকর্মের ভাগ নিতে হয়। বিগত ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারির পর ওসব ডকইয়ার্ডের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো উচ্ছেদ অভিযান হয়নি। ওই ডকইয়ার্ডগুলো নদীও দূষণ করছে। পাশাপাশি নৌপথে নিরাপদে চলাচলের জন্য লঞ্চের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ড্রাফট ও উচ্চতা- এই চারটি বিষয় বৈজ্ঞানিক ও আনুপাতিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু যাত্রী ধারণক্ষমতা বাড়াতে মালিকরা খেয়াল-খুশিমতো লঞ্চের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা বাড়ান। ফলে লঞ্চ ত্রুটপূর্ণ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ঈদের সময় অসংখ্য আনফিট ও লক্কড়ঝক্কড় লঞ্চ নদীতে নামে। তাতে যাত্রীদের জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, শুধুমাত্র বুড়িগঙ্গার সাড়ে ৪ হাজার বিভিন্ন ধরনের লঞ্চের মধ্যে মাত্র ৭৮২টির ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়েছে। ওসব লঞ্চের ৫০ শতাংশের কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই। অথচ গত ৩০ বছরে নৌদুর্ঘটনায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যদিও বিআইডাব্লিউটিএর নৌসংরক্ষণ ও পরিচালনা বিভাগের মতে, গত ৬৬ বছরে দেশে ২ হাজার ১২২টি নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে। তাতে ৬ হাজারের মতো যাত্রী নিহত হয়েছে। তবে লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদের মতে, নৌপথে যথেষ্ট তদারকির ব্যবস্থা আছে, সুতরাং ঈদে লঞ্চ দুর্ঘটনা না ঘটারই সম্ভাবনা।
এদিকে অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থার (জাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল জানান, সদরঘাট থেকে যেসব লঞ্চ বিভিন্ন রুটে চলাচল করে তার কাগজপত্রে কোনো ত্রুটি নেই। ঈদের আগে প্রতিটি টার্মিনালের জাহাজগুলো চেকআপ করা হয়। যেসব লঞ্চে ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো ঠিক করতে ডকইয়ার্ডে নেয়া হয়। আর ত্রুটিবিচ্যুতি ঠিক করে পুরো জাহাজকে রং করে নেয়া হয়। আর স্টিল বডিতে যত রং করা হয়, তত ভালো থাকে।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বিআইডাব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক জয়নাল আবেদীন জানান, ‘লক্কড়ঝক্কড় লঞ্চ নদীতে নামতে দেয়া হবে না। ঈদের ১০ দিন আগে থেকেই বেশ কয়েকটি মোবাইল কোর্ট থাকবে। র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ পর্যাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থাকবে। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে কোনো লঞ্চ যাতে চলতে না পারে সেজন্যও কঠোর নজরদারি থাকবে। অন্য বছরের তুলনায় এবছর লঞ্চের বিশেষ সার্ভিস বাড়ানো হয়েছে। আর যেসব লঞ্চ যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে রং করা হচ্ছে, সেগুলোর দিকে আরো বেশি নজর রয়েছে।
Leave a Reply